দারসুল কুরআন
দারসুল কুরআন | আল্লাহ প্রদত্ত মহাবিজয়
শাইখ মুহাম্মাদ হারুন হুসাইন
আল্লাহ তা‘আলার অমিয়বাণী
بِسۡمِ ٱللهِ ٱلرَّحۡمٰنِ ٱلرَّحِيۡمِ﴿إِذَا جَآءَ نَصۡرُ ٱللهِ وَٱلۡفَتۡحُ وَرَأَيۡتَ ٱلنَّاسَ يَدۡخُلُوۡنَ فِيْ دِيْنِ ٱللهِ أَفۡوَاجٗا فَسَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّكَ وَٱسۡتَغۡفِرۡهُۚ إِنَّهُۥ كَانَ تَوَّابَۢا﴾
সরল অর্থ
পরম করুণাময় অতীব দয়াশীল আল্লাহর নামে ॥
“১. যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে। ২. আর তুমি দেখবে দলে দলে মানুষ আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। ৩. তখন তুমি তোমার রবের প্রসংশাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাও! নিশ্চয়ই তিনি অধিক তাওবাহ্ ক্ববুলকারী।”[১]
বিশেষ শব্দাবলীর অর্থ
الْفَتْحُ ‘আল-ফাত্হ’ : অর্থ- বিজয়। এখানে মক্কা বিজয় উদ্দেশ্য। যা অষ্টম হিজরীতে সংঘটিত হয়। أَفْوَاجًا ‘আফওয়া-জান’ : এটি فوج-এর বহুবচন। অর্থ- দলে দলে।
সূরাটির নামকরণ
প্রথম আয়াতে উল্লেখিত نصر শব্দের আলোকে এ সূরারনাম রাখা হয় সূরা আন্ নাস্র। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রতি বিদায়ী ইঙ্গিত থাকার কারণে এটিকে سورة التوديع ‘সূরাতুদ তাওদী‘আ’ বা বিদায়ী সূরাও বলা হয়।
অবতরণকাল
সূরা আন্ নাস্ রাসূল (সাঃ)-এর শেষ জীবনে অবতীর্ণ হয়। এ সূরাটিতে রাসূল (সাঃ) এ মহাপ্রয়াণ নিকটবর্তী বলে ইঙ্গত দেওয়া হয়েছিল। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত-
ইবনু ‘আব্বাস (রাযিঃ) এ উক্তি দ্বারা জানা যায় যে, পরিপূর্ণ সূরা হিসাবে এটি কুরআনের সর্বশেষ নাযিল হওয়া সূরা।
দারস্ ও সূরাটির বিষয়বস্তু
মহান আল্লাহর সাহায্য ও মক্কা বিজয়ের সু-সংবাদ দিয়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্তে তাঁর গুণগান ও ইস্তেগফার করার জন্য নাবী (সাঃ)-এর প্রতি মহান আল্লাহর নির্দেশ। এ কথা সু-স্পষ্ট যে, বিজয় কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য ব্যয়িত সকল সাধানার এক চূড়ান্ত ফসল। অভিষ্ট লক্ষ্যে স্থির থেকে দীর্ঘ কর্মযজ্ঞের পর এ বিজয় আসতেও পারে, আবার নাও আসত পারে। পার্থিব করণে যারা লড়াই-সংগ্রাম করেন, তারা কাঙ্খিত বিজয় অর্জন না করতে পারলে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আত্ম বেদনায় ক্লিষ্ট হতে থাতেন। তাদেরকে চতুর্দিক থেকে হতাশা গ্রাস করে। ফলে অনেকটা বিমুর্ষ হয়ে পড়েন, যা আমরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র পর্যায়ে পরিলক্ষিত করে আসছি। আর এটাই মানবীয় দূর্বলতা।
পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর দীন বিজয়ের কাজে নিয়েজিত কোনো বান্দাহ বিজয় দ্বারা দুনিয়াবী সাফল্যকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিশ্বাস করেন না। তাঁদের চূড়ান্ত সাফল্য বা বিজয় হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর দুনিয়াবী কোনো বিজয় আসলে তাঁরা সেটিকে মহান আল্লাহর একটি নি‘আমত মনে করে কৃতজ্ঞ চিত্তে সাজদাবনত হয়ে দয়াময় মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে মশগুল হয়ে পড়েন। এখানেই দ্বীন ও দুনিয়াবী বিজয়ার্জনের পার্থক্য।
মক্কা বিজয় প্রসঙ্গে
মক্কা পৃথিবীর নাভি। এ নগরকে উম্মুল ক্বুরা বলা হয়। এখানেই রয়েছে ‘কাবা’ বিশ্ব মুসলিমের ক্বিবলা। মীনা, আরাফা ও মুযদালিফাসহ অনেক স্মৃতি বিজড়িত পূন্যভূমি। এখানেই জন্ম নেন বিশ্ব নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)। ৪০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার অব্যবহিত পর পরই এ মক্কায়-ই প্রথম ওহী নাযিল হয়। নবুওয়্যাত ও রিসালত পেয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে নাবী (সাঃ) মক্কাবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেন। বেশিরভাগ মক্কাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নাবী (সাঃ)-এর দাওয়াত শুধু প্রত্যাখ্যান করেনি; বরং তাঁকে হত্যা করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি। যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথী হয়েছিলেন, তাঁদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে এ মক্কাবাসী। অবশেষে ভিটে-মাটি ছাড়তে বাধ্য করেছে। মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানাবী (সাঃ) যথাসম্ভব সঙ্গি-সাথী নিয়ে সু-দূর ইয়াসরিব-এ হিজরত করেন। এ ইয়াসরিব হয় মদীনাতুন নাবী বা নাবী (সাঃ)-এর শহর, ঐতিহাসিক সোনার মদীনা।
৬ষ্ট হিজরীতে নিরস্ত্র কাফেলা নিয়ে শুধু আল্লাহ তা‘আলার ঘর ‘কাবা’য় ‘উমরাহ্ করার নিয়তে সফর করেন। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা রহমতের নাবী, বিশ্ব নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে মক্কায় প্রবেশ করতে দেয়নি। ‘উমরাহ্ না করেই ফিরে যেতে হলো আল্লাহর প্রেরিত এ মহাপুরুষকে। তাঁর (সাঃ) সফর সঙ্গীদের মনে মক্কায় প্রবেশ ও ‘উমরাহ্ না করতে পারার কি যাতনা, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। অবশেষে আল্লাহর দয়ায় ৮ম হিজরীতে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ -ফালিল্লাহিল হাম্দ। কিন্তু সে বিজয়ে কি কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল? মুহাম্মাদ (সাঃ) মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে কি প্রতিশোধ নিয়ে ছিলেন? তিনি কি তাদেরকে ক্ষমা করে দেননি? বলেননি : ‘তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো প্রতিশোধের দাবী নেই।’ শুধু কি তা-ই (?) মক্কার মুশরিক-কাফির; অথচ সমাজ নেতা, তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন। তাঁদের কাছে যারা আশ্রয় নেবে, তাদেরও নিরাপত্তা দিলেন। কী আশ্চর্য্য মহানুভবতা, কী মহৎ প্রাণ ব্যক্তিত্ব, কী শান্তির দূত!
বিজয় ও করণীয়
মহান আল্লাহর বাণী : ﴿إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ﴾
“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে।”
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে কাফিরদের মুকাবেলায় সকল যুদ্ধে বিজয় লাভেরা জন্য সাহায্য করার প্রতি ইঙ্গিত করেন। আর সাহায্যের পর বিজয় বলতে মক্কা বিজয় উদ্দেশ্য। অর্থাৎ- শিঘ্রই মক্কা নগরী জয় হবে, তখন আর সেটি কাফিরদের রাজ্য থাকবে না; বরং এটা দারুল ইসলামে পরিণত হয়ে যাবে এবং আরবের বিভিন্ন গোত্র দলবেধে এসে ইসলামে প্রবেশ করবে। সে ঘটনা কি ঘটেনি? নিশ্চয়ই। কিন্তু আজকের কোনো ক্ষুদ্রাঞ্চল কোনো মুসলিম দ্বারা বিজিত হলে সেখানকার নাগরিক প্রাণ ভয়ে পালাবে কেন? ইসলামের বিজয় কি কোনো আতংকের নাম, নাকি শান্তির পয়গাম। বিষয়টি কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? বলুনতো! ‘ঈসা ('আঃ)-এর অবতরণের পর যে বিশ্ব বিজয় হবে, সেখান থেকে কালিমা পাঠকারী কোনো মুসলিম পালাবে? ইসলামী রাষ্ট্রতো তা-ই, যেখানে দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। অমুসলিম নাগরিকরাও পাবে সমান নিরাপত্তা। তাদের মধ্যে কেউ বিদ্রোহী না হলে তারা পাবে মুসলিমদের নিকট থেকে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার ও দান-দক্ষিণা। কোনো দেশ বা অঞ্চলের বিজয় মূল্যায়ণ করতে হলে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
মহান আল্লাহর বাণী : ﴿فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ﴾
“অতঃপর প্রশংসাসহ তোমার রবের তাসবিহ পাঠ করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা চাও!”
এ আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সাঃ)-কে জানিয়ে দেন যে, দুনিয়া থেকেতো তোমার বিদায়ের সময় নিকটে এসে গেছে। তাই তুমি তোমার রবের প্রশংসায় গভীর মনোনিবেশ করো। আর ইস্তেরগফার বা ক্ষামা চাওয়া বান্দার নৈতিক দায়িত্ব। বলা যায় এটি উলুহিয়্যাতের একান্ত দাবী। এ কথা দ্রুব সত্য যে, মহা নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) মহান আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দাহ ছিলেন। তাই তিনি সবচেয়ে বেশী ইস্তেগফার করতেন। মা ‘আয়িশাহ্ (রাযীঃ) বলেন : এ সূরাটি নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রত্যেক সালাতে নিম্নোক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন : (দু‘আটি এই-)
سُبْحَانَكَ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِيْ.
“সুবহা-নাক রাব্বানা- ওয়া বিহামদিকা আল্লাহ-হুম্মাদগ ফিরলী।।”[২]
অপর বর্ণনায় উল্লেখিত আছে যে, এ সূরটি নাযিলের পর থেকে রাসূল (সাঃ) রুকূ‘ ও সাজদায় নিম্নোক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন। দু‘আটি এই-
سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِيْ.
“সুবহা-নাকা আল্লা-হুম্মা রাব্বানা ওয়াবিহামদিকা আল্লাহুম্মাগ ফিরলী।”[৩]
সহীহ মুসলিম-এর অপর এক বর্ণনায় এসেছে- (এ সূরাটি নযিল হওয়ার পর) রাসূল (সাঃ) বেশি বেশি বলতেন :
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ.
“সুবহা-নাল্লাহি ওয়াবিহাম্দিহী, আস্তাগফিরুল্লাহা ওয়া আতূবু ইলাইহি।”[৪]
দারসের শিক্ষাসমূহ
১. নি‘আমতপ্রাপ্ত হলে শুকরিয়া আদায় করা ওয়াজিব। আর এর অন্তর্ভুক্ত হবে সাজদায়ে শুকর আদায় করা।
২. রুকূ‘তে “সুবহানাকা আল্লা-হুম্মা ওয়া বিহামদিকা আল্লা-হুম্মাগফিরলী” বলা বিধিসম্মত।
৩. তাওবাহ্-ইস্তেগফারের জন্য ত্রুটি থাকা জরুরী নয়; বরং বান্দাহ হওয়ার দাবী হলো সর্বদা মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
৪. নাবী (সাঃ)-এর প্রতি ভুল-ত্রুটির অপবাদ দেওয়া ঈমান না থাকার নামন্তর। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে মা‘সূম বা নিষ্পাপ ঘোষণা করেছেন।
৫. বিজয় মানে দুনিয়বী সফলতা নয়; বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে পরকালের বিজয় মূখ্য।
উপসংহার
মু’মিনদের বিজয়ে আনন্দ প্রকাশ করা ও খুশী হওয়া ঈমানের দাবী। কিন্তু সে বিজয় যদি হয় প্রশ্নবিদ্ধ! কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ‘র বদলে কোনো একটি বিতর্কিত কিংবা ভ্রান্ত আদর্শ বাস্তবায়ন? সেখানে যদি মানবতা বিপন্ন হয়- সত্য পথের অনুসারীগণ যদি নিবিঘ্নে কুরআন-হাদীস চর্চা করতে না পারেন, তাহলে এ বিজয়কে কি হিসেবে মূল্যায়ণ করবেন? আমরা আফগানিস্তানের মুসলিমদের জন্য দু‘আ করি, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাঁদেরকে সত্যিকারের বিজয় দান করেন। তাঁরা যেন মহান আল্লাহর দুশমনের হাতের গুটি না হয়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সত্য উপলব্ধি করার, জানার, বুঝার ও মানার তাওফীক্ব দিন -আমীন।
[১]. সূরাহ্ আন্ নাসর ১১০ : ১-৩।
[২]. সহীহুল বুখরী- হাঃ ৪৯৬৭।[৩]. সহীহুল বুখারী- হাঃ ৪৯৬৮।
[৪]. সহীহ মুসলিম- হাঃ ৪৮৪।
ঢাকায় সূর্যোদয় : 6:17:45
সূর্যাস্ত : 5:11:51
আপনার মন্তব্য